ডায়াবেটিস কি? কেন হয়? বাঁচার উপায় কি?
বর্তমানে ডায়াবেটিস আমাদের সবার কাছে পরিচিত একটি রোগ। বর্তমান বিশ্বে এর পরিমাণ এত বেশি যে প্রায় প্রত্যেক ফ্যামিলিতে একজন হলেও এই রোগে আক্রান্ত রোগী রয়েছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী ডায়াবেটিস একটি মহামারী রোগ। বর্তমানে ডায়াবেটিস রোগীর পরিমাণ এত বেশি বেড়েছে যে সম্প্রীতি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এই ঘোষণা দিয়েছে। ডায়াবেটিস এমন একটি রোগ যা একেবারে নিরাময় করা সম্ভব না তবে একে নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব।
ডায়াবেটিস কি?
আমরা যখন কোন কার্বোহাইড্রেট বা শর্করা জাতীয় খাবার খায় তখন তা ভেঙ্গে গ্লুকোজে পরিণত হয়। গ্লুকোজ গুলো কাজ সম্পন্ন করার জন্য ইনসুলিন এর প্রয়োজন হয় আর এই ইনসুলিন হলো এক ধরনের হরমোন। ডায়াবেটিস হল এক ধরনের হরমোন জনিত রোগ। এর কাজ হচ্ছে গ্লুকোজ গুলোকে মানুষের দেহের কোষগুলোয় পৌঁছে দেওয়া। যার থেকে আমরা অনেক পরিমান শক্তি পেয়ে থাকি যে শক্তি দিয়ে আমরা কাজকর্ম করতে পারি।
আর যখন গ্লুকোজ আমাদের শরীরের কোষে পৌঁছায় না তখন আমাদের দৈনন্দিন কাজ করতে অসুবিধা হয় কারন তখন আমাদের শক্তি কমে যায়।
আর শক্তি উৎপাদন না হলে আমাদের রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ বেড়ে যায়। আর গ্লুকোজের পরিমাণ বেড়ে গেলে প্রস্রাবের পরিমাণও বেড়ে যায় কারণ অতিরিক্ত গ্লুকোজ গুলো প্রস্রাবের সাথে বাহির হতে থাকে।
তাই ডায়াবেটিস রোগীদের ঘন ঘন প্রস্রাব হতে থাকে যার কারণে তাদের খিদে বেশি লাগে এবং তাদের দুর্বলতা বেড়ে যায়। আর তার জন্য প্রয়োজন ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখা। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে না রাখলে ডায়াবেটিস রোগীর রক্তনালী, কিডনি, চোখ ও হৃদযন্ত্রের সমস্যা সহ নানা ধরনের শারীরিক জটিলতা দেখা দিতে পারে।
ডায়াবেটিস কত প্রকার ও কি কি
ডায়াবেটিস দুই প্রকার:
- টাইপ-১ ডায়াবেটিস
- টাইপ-২ ডায়াবেটিস
টাইপ ১ ডায়াবেটিস কি
টাইপ ১ ডায়াবেটিস টি শিশুদের ডায়াবেটিস বা অপ্রাপ্তবয়স্কদের (জুভেনাইল) ডায়াবেটিস নামে পরিচিত। আমরা টাইপ 1 ডায়াবেটিস সম্পর্কে জানার আগে অবশ্যই ইনসুলিনের সম্পর্কে জানতে হবে। ইনসুলিন হলো এক ধরনের হরমোন যা রক্তের শর্করা শরীরের ব্যবহার্য করে তুলতে সাহায্য করে।
আর যখন আমাদের শরীরে ইনসুলিনের পরিমাণ কমে যায় তখন শর্করার পরিমাণ বাড়তে থাকে আর শর্করার পরিমাণ বাড়তে থাকলে এটি আমাদের শরীরে অনেক বিপাকীয় প্রক্রিয়ায় বাধাগ্রস্ত করতে থাকে। আরে ইনসুলিনের এই প্রক্রিয়াটি টাইপ 1 ডায়াবেটিস।
টাইপ ২ ডায়াবেটিস কি
টাইপ ২ ডায়াবেটিস টি একটি বিপাকীয় রোগ বা টাইপ ২ ডায়াবেটিস নামেও আমরা যেনে থাকি। এই রোগটি সব বয়সের মানুষের মধ্যে দেখা দিতে পারে। তবে এ রোগে মধ্যবয়সী ও বৃদ্ধরা বেশি আক্রান্ত হয়। টাইপ ২ ডায়াবেটিস রোগে আক্রান্তের পরিমাণ সবথেকে বেশি। যার কারণে এটি ডায়াবেটিসের একটি সাধারণ ধাপ।
এই রোগের প্রধান কারণ হলো ইনসুলিনের পরিমাণ কমে যাওয়া। আর ইনসুলিনের পরিমাণ কমে গেলে রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ কমে যায় যার কারণে কোষের মধ্যে গ্লুকোজ গুলো পৌছায় না এবং শক্তি উৎপাদন হতে পারে না। ডায়াবেটিস রোগীদের মধ্যে টাইপ ২ ডায়াবেটিস রোগে আক্রান্তের পরিমাণ ৯০%।
টাইপ 2 ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকি কিভাবে কমাবো?
টাইপ 2 ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কমাতে হলে দৈহিক ওজন বেশি বাড়তে দেওয়া যাবে না। ওবেসিটি এবং টাইপ ২ ডায়াবেটিস এর মধ্যে গভীর সম্পর্ক রয়েছে আপনি যত বেশি মোটা হবেন, ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা তত বেশি বাড়বে।
সাম্প্রতিক গবেষণা অনুসারে, নিয়মমাফিক প্রয়োজনীয় ব্যায়ামের মাধ্যমে দৈহিক ওজনের ৫% হ্রাস, আপনার টাইপ ২ ডায়াবেটিসের আশঙ্কা 50% এরত্ত বেশি কমিয়ে দেয়।পেটের চর্বি কমান এবং টাইপ 2 ডায়াবেটিস ত্ত হূদরোগের আশঙ্কা থেকে দূরে থাকুন।
টাইপ ২ ডায়াবেটিস রোগীর যে কাজগুলো করা প্রয়োজন
টাইপ ২ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়া রোগী অথবা আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কমাতে যে কাজগুলো করা প্রয়োজন।
- নিয়মিত অন্তত ১৫ মিনিট শরীরচর্চা করা প্রয়োজন।
- ফাইবার সমৃদ্ধ খাবার যেমন ওট্স, ডালিয়া ইত্যাদি খান।
- ফল ও শাকসবজি বেশি করে খাওয়া প্রয়োজন।
- প্রতিদিন কমপক্ষে ৮ গ্লাস পানি পান করা প্রয়োজন।
- দুপুর রাতের খাবারের পর ২ চা-চামচ ইসবগুল নিন।
টাইপ ২ ডায়াবেটিস রোগীদের যে সব বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে
টাইপ ২ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়া রোগী অথবা আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কমাতে যে বিষয়গুলোর উপর সতর্ক থাকতে হবে।
- সিম্পল কার্বোহাইড্রেট যেমন বাত, রুটি ইত্যাদি খাওয়ার পরিমাণ কমিয়ে দিন।
- ফাস্ট ফুড এবং কার্বোনেটেড ড্রিংসকে না বলুন।
- ধূমপান থেকে বিরত থাকতে হবে।
- মদ্যপান এড়িয়ে চলুন।
- মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণ করুন।
ডায়াবেটিস এর মান
ডায়াবেটিস চিহ্নিত করার জন্য ডায়াবেটিসের নাম জানা অত্যন্ত প্রয়োজন।আমেরিকান ডায়াবেটিক অ্যাসোসিয়েশনের গাইডলাইন অনুযায়ী এইচবিএ১সির মান ৫.৭-এর নিচে থাকলে তাকে স্বাভাবিক ধরা যায়।
তবে এর মান যদি ৬.৫ এর বেশি হয় তাহলে ডায়াবেটিস আছে বলে ধরা হয়।মান ৫.৭ থেকে ৬.৫-এর মধ্যে থাকলে প্রি-ডায়াবেটিস বা ডায়াবেটিসের পূর্বাবস্থা হিসেবে বিবেচনা করতে হবে।
ডায়াবেটিস এর লক্ষন
ডায়াবেটিস রোগীকে বিভিন্ন ধরনের লক্ষণ দেখা দেয় সেগুলো হলোঃ
- তৃষ্ণার পরিমাণ বেড়ে যাওয়া।
- ক্ষুধার পরিমাণ বেড়ে যাওয়া।
- প্রস্রাবের পরিমাণ বেড়ে যাওয়া।
- ওজনের পরিমাণ কমে যাওয়া।
- খিটখিটে ভাব এবং অন্যান্য মেজাজে পরিবর্তন দেখা দেওয়া।
- ক্লান্তি দুর্বলতা বৃদ্ধি পাওয়া।
- দৃষ্টিশক্তি কমে যাওয়া বা ঝাপসা দেখা।
ডায়াবেটিস রোগীর এই লক্ষণগুলো দেখা দেয়। তবে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে এই লক্ষণগুলো অন্যান্য রোগের মধ্যেও রয়েছে হঠাৎ করে কোনো সিদ্ধান্ত না নিয়ে আমরা ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
ডায়াবেটিস কিভাবে নির্ণয় করা হয়
ডায়াবেটিস নির্ণয়ের জন্য রোগীকে সকালে খালি পেটে রক্তের গ্লুকোজের পরীক্ষা করতে হয়। আর এই পরীক্ষার পর রোগীকে ৭৫ গ্রাম গ্লুকোেজের শরবত খাওয়ানো হয়। শরবত খাওয়ানোর দুই ঘন্টা পর আবার গ্লুকোজের পরীক্ষা করা হয়। আর এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে একজন রোগীকে নির্ভুলভাবে ডায়াবেটিস পরীক্ষা করা হয়।
এই পরীক্ষা দেওয়ার সময় খুবই কম অনেক ঝামেলায় পড়তে হয় কেননা প্রায় ৮ ঘণ্টার বেশি রোগীকে না খেয়ে থাকতে হয়। তারপর প্রথম রক্ত পরীক্ষা দেয়ার পর রোগীকে পায় আবার ২ ঘন্টা ল্যাবের মধ্যে থাকতে হয়।
ডায়াবেটিসের চিকিৎসা
ডায়াবেটিস রোগীদের যেসব চিকিৎসা ব্যবস্থার উপর বেশি নজর দিতে হবে সেগুলো হলোঃ
- প্রথমত এই ধরনের রোগীদের যেহেতু ইনসুলিনের পরিমাণ কম বা রক্তে ইনসুলিন তৈরি হচ্ছে না সেজন্য অবশ্যই তাদেরকে ইনসুলিন গ্রহণ করতে হবে। কেননা সঠিক পরিমাণ ইনসুলিন না থাকলে একজন রোগীর নানা ধরনের সমস্যা সৃষ্টি হতে থাকে। এজন্য সঠিক পরিমাণ ইনসুলিন ব্যবহার করে ডায়াবেটিস এর মান ঠিক রাখতে হবে।
- ডায়াবেটিস রোগীদের খাবারে বিশেষভাবে নজর দিতে হবে। তাদেরকে সুষম ও স্বাস্থ্যকর ডায়েট সম্পর্কযুক্ত খাবার খাওয়া প্রয়োজন।
- ব্যায়াম বা শরীরচর্চা ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ । কারণ ব্যায়ামের ফলে একজন ডায়াবেটিস রোগীর রক্তে শর্করার পরিনাম বাজায় থাকে। আর ব্যায়ামের মাধ্যমে একজন ডায়াবেটিস রোগী তার ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে অনেক ভূমিকা পালন করে।
> আরও পড়ুনঃ-