মঙ্গল গ্রহে মানুষ- মঙ্গল গ্রহ সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু তথ্য

মঙ্গল গ্রহে মানুষ- মঙ্গল গ্রহ সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু তথ্য

মঙ্গল গ্রহ সৌরজগতের চতুর্থতম গ্রহ এবং এটি সৌরজগতের দ্বিতীয় ক্ষুদ্রতম গ্রহ। পৃথিবী থেকে এই গ্রহটি দেখতে অনেকটা লালচে লাগে তাই এর নাম দেয়া হয়েছে লাল গ্রহ। মঙ্গল সৌরজগতের শেষ অন্তর্বর্তী গ্রহ। পৃথিবীর পরে মঙ্গলের অবস্থান।

আর আমরা অনেক সময় পৃথিবী থেকে রাতের আকাশের দিকে তাকালে মঙ্গল গ্রহকে দেখতে পায় এর কারণ হচ্ছে মঙ্গল গ্রহ দেখতে অনেকটা লাল রঙ্গের ও অনেকটা উজ্জল। বিজ্ঞানীরা মঙ্গল গ্রহকে পৃথিবীর দ্বিতীয় আবাসস্থল হিসেবে দেখতে চাই। এর কারণ হচ্ছে মঙ্গল গ্রহের সাথে পৃথিবীর অনেক কিছুর মিল রয়েছে।

আজ থেকে ৪০০ বছর আগে অর্থাৎ 16০০ শতাব্দীর সাহিত্যে মঙ্গলকে আমাদের দ্বিতীয় পৃথিবী বলা হয়েছে। বর্তমানে বৈজ্ঞানিকদের পরিকল্পনা ও পদক্ষেপ দেখে মনে হচ্ছে মঙ্গলি  হতে চলেছে আমাদের দ্বিতীয় পৃথিবী। অর্থাৎ হয়তো একদিন মঙ্গল গ্রহে মানুষ বসবাস করতে পারবে।

মঙ্গল গ্রহের ইতিহাস

মঙ্গল হল সূর্য থেকে চতুর্থ গ্রহ এবং প্রায়শই এটির লালচে চেহারার কারণে লাল গ্রহ বলা হয়। এখানে মঙ্গল গ্রহের একটি সংক্ষিপ্ত ইতিহাস রয়েছে:

প্রাচীনকাল: মঙ্গল গ্রহ হাজার হাজার বছর ধরে রাতের আকাশে দৃশ্যমান ছিল এবং এর লাল রঙের কারণে যুদ্ধের রোমান দেবতার নামে নামকরণ করা হয়েছিল, যা রক্তপাতের সাথে জড়িত ছিল।

17 এবং 18 শতক: টেলিস্কোপের আবিষ্কার জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের মঙ্গলকে আরও ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করার অনুমতি দেয় এবং এর মেরু বরফের ক্যাপ এবং পৃষ্ঠের উপর অন্ধকার চিহ্নের মতো বেশ কয়েকটি বৈশিষ্ট্য আবিষ্কৃত হয়।

19 শতক: ইতালীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানী জিওভান্নি শিয়াপারেলি মঙ্গল গ্রহের পৃষ্ঠে যাকে তিনি “কানালি” বা চ্যানেল বলেছেন তা পর্যবেক্ষণ করেছিলেন। এর ফলে গ্রহে বুদ্ধিমান জীবনের সম্ভাবনা নিয়ে জল্পনা শুরু হয়েছিল।

20 শতকের প্রথম দিকে: আমেরিকান জ্যোতির্বিজ্ঞানী পার্সিভাল লোয়েল বিশ্বাস করতেন যে মঙ্গল গ্রহের খাল একটি উন্নত সভ্যতার প্রমাণ যা গ্রহের মেরু বরফের ছিদ্র থেকে তার শুষ্ক অঞ্চলে জল পরিবহনের জন্য খালের একটি নেটওয়ার্ক তৈরি করেছিল।

1960: মঙ্গল গ্রহে যাওয়ার প্রথম মহাকাশযানটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন দ্বারা চালু হয়েছিল। প্রথম সফল মিশন ছিল মেরিনার 4 মহাকাশযান, যেটি 1965 সালে মঙ্গল গ্রহে উড়েছিল এবং গ্রহের পৃষ্ঠের প্রথম ক্লোজ-আপ চিত্রগুলি ফিরিয়ে দিয়েছিল।

1970-1990 এর দশক: ভাইকিং ল্যান্ডার সহ মঙ্গলে আরও কয়েকটি মহাকাশযান পাঠানো হয়েছিল, যা গ্রহে জীবনের প্রমাণ অনুসন্ধান করেছিল। তবে কোনো চূড়ান্ত প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

2000-এর দশক-বর্তমান: অসংখ্য মহাকাশযান মঙ্গল গ্রহের অধ্যয়ন চালিয়ে গেছে, যার মধ্যে রয়েছে মার্স গ্লোবাল সার্ভেয়ার, মার্স রিকনেসান্স অরবিটার, এবং মার্স কিউরিওসিটি রোভার, যা 2012 সালে গ্রহে অবতরণ করেছে এবং এখনও এর পৃষ্ঠটি অন্বেষণ করছে।

আজ, মঙ্গল গ্রহ বৈজ্ঞানিক গবেষণা এবং অন্বেষণের কেন্দ্রবিন্দু হিসাবে রয়ে গেছে, ভবিষ্যতে এই গ্রহে মানব মিশনের পরিকল্পনা রয়েছে।

বৈজ্ঞানিকদের ধারণা এখন মঙ্গল গ্রহ যেমন আছে ১০০ কুটি বছর আগে মঙ্গলগ্রহ এমন ছিলনা। তাদের ধারণা তখন মঙ্গল গ্রহে ছিল প্রবাহমান জলরাশি , ঘন বায়ুমণ্ডল এবং সক্রিয় আগ্নেয়গিরি। কিন্তু পরবর্তীতে সময় চক্রের পরিবর্তনের সাথে আস্তে আস্তে পানি গুলো শুকিয়ে যায় এবং অগ্নিগিরি নিষ্ক্রিয় হতে থাকে।

মঙ্গলের উপগ্রহ

পৃথিবীর মত মঙ্গল গ্রহেরও উপগ্রহ রয়েছে। মজার ব্যাপার হলো আমাদের পৃথিবীতে উপগ্রহ হল একটি আর সেটি হল চাঁদ কিন্তু মঙ্গলের উপগ্রহ দুটি এর মধ্যে একটি হলো ফোবোস অপরটি হল ডেইমজ। আর এই দুটি উপগ্রহ আবিষ্কার হয় ১৮৭৭ সালে।

মঙ্গল গ্রহ সম্পর্কে কিছু অজানা তথ্য

লাল রঙ্গের কারণে রোমান যুদ্ধের দেবতার নামে গ্রহটির নামকরণ করা হয়েছে মার্স। মঙ্গল গ্রহের আকাশে রং গোলাপি দেখায় এর কারণ হচ্ছে মঙ্গলের আকাশে ঘন মেঘ জমে থাকা। আর মঙ্গলগ্রহে স্থায়ী দুটি বরফ তুপি আছে। মঙ্গল গ্রহের দক্ষিণ মেরুতে যে পরিমাণ বরফ রয়েছে তা যদি গলিয়ে দেয়া হয় সমস্ত মঙ্গল গ্রহ পানিতে ডুবে যাবে কেননা এই পানির গভীরতা হবে প্রায় ৩৬ ফুট।

মঙ্গল গ্রহ আমাদের পৃথিবী থেকে অনেক বড় এর কেন্দ্রীয় অংশের ব্যাসার্ধ ১৭৯৪ কিলোমিটার। আর মঙ্গল গ্রহের কেন্দ্র ভাগ মূলত লোহা ও নিকেল দিয়ে গঠিত আর এর সাথে রয়েছে ১৬-১৭ অংশ সালফার।

মঙ্গলের বাতাসের গতিবেগ পৃথিবী থেকে অনেক বেশি। মঙ্গলে মেরু অঞ্চলে বাতাসের গতিবেগ প্রতি ঘণ্টায় 400 কিলোমিটার।

মঙ্গল গ্রহের আগ্নেয়গিরির পরিমাণ অত্যন্ত বেশি। মঙ্গলের আগ্নেয়গিরির অলিম্পাস মনস আয়তনে পাই আমেরিকার আর্জেন্টিনা রাজ্যের সমান।

মঙ্গল গ্রহে মানুষ

শত শত বছর ধরে মানুষ মঙ্গল গ্রহে মানুষ যাওয়ার পরিকল্পনা করিতেছে। আর এটি হয়তো একসময় বাস্তবায়ন হবে কেননা বিজ্ঞানীরা যে পরিকল্পনা অনুযায়ী চলছে তা একসময় বাস্তবায়ন করা সম্ভব।

মঙ্গল গ্রহে রোবট অবতরণ সম্পর্কে-

বৈজ্ঞানিকেরা মঙ্গল গ্রহ সম্পর্কে জানার জন্য অনেকভাবে চিন্তাভাবনা করতে শুরু করলো কিভাবে মঙ্গল গ্রহে পৌঁছানো সম্ভব। তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য সোভিয়েত ইউনিয়ন নামের একটি সংস্থা 1971 সালে মাক্স-টু ও মাক্স থ্রি নামক দুটি রোবট কে প্রথম মঙ্গল গ্রহে পাঠায়। আর তাদের রোবট 2 টি মঙ্গল গ্রহে ল্যান্ড করানোর সময় ফেটে যায় আর তাদের মিশন টি অসম্পূর্ণ হয়ে পরে।

তারপর ১৯৭৬ সালে হাইকিং-১ নামক একটি রোবটকে মঙ্গল গ্রহে পাঠান আর সেটি মঙ্গল গ্রহের মাটিতে সুস্থভাবে ল্যান্ড করে। এটি ছিল মঙ্গল গ্রহে প্রথম সফল মিশন। আর এই রোবট পৃথিবীবাসীর কাছে সর্বপ্রথম মঙ্গলের ছবি পাঠায়।

২১ বছর পর বৈজ্ঞানিকেরা এমন একটি রোবট কে পাঠায় যেটি মঙ্গল গ্রহে সফল ভাবে ল্যান্ড করে এবং মঙ্গলের মাটিতে ঘুরে বেড়ায় আর এটির নাম ছিল সুয়েজনা।

সয়েজনার পর নাসা আরো দুটি রোবট মঙ্গল গ্রহে পাঠায় যার নাম ছিল স্পিড ও অপরচুনিটি। এরমধ্যে সবথেকে বড় ব্যাপার হলো নাসার এই মিশনটি ছিল মাত্র ৯০ দিনের। কিন্তু মঙ্গল গ্রহে অতিরিক্ত বাতাস থাকার কারণে এইটি অটোমেটিকেলি পরিষ্কার হতে থাকে এবং এর সোলার সিস্টেম সূর্যের আলো থেকে অটোমেটিক্যালি চার্জ হতে থাকে। আর এই মিশনটি ৯০ দিন থেকে বেড়ে ৬ বছর পর্যন্ত চলতে থাকে। ছয় বছর পর মঙ্গল গ্রহের মাটি ক্ষার প্রবল হওয়ায় এ দুটি রোবট নষ্ট হয়ে যায়।

স্পিড ও অপরচুনিটির পর নাসা আরো একটি রোবট মঙ্গল গ্রহে পাঠায় যার নাম ছিল  ট্রিওসিটি। আর এটি মঙ্গল গ্রহের মাটিতে ১৩ বছর অক্ষত ছিল  এবং আমাদের ঘুরে ঘুরে তথ্য দিতে থাকলো।

রোবট গুলো আমাদের যে তথ্য দিয়েছে তা থেকে আমরা বুঝতে পারি মঙ্গল গ্রহকে আমরা পৃথিবীর মতো ব্যবহারের উপযুক্ত করতে পারব কিভাবে। আর এখনো বৈজ্ঞানিকেরা বিভিন্ন ধরনের রোবট পাঠাচ্ছে এবং মঙ্গল গ্রহ সম্পর্কে জানার চেষ্টা করছে।

এর মধ্যে বিশেষ একটি ব্যাপার হলো একটি রোবট আমাদেরকে ছয় মাসে যে তথ্য দেয় একটি মানুষের তা দুই ঘণ্টার মধ্যে করা সম্ভব। কিন্তু শুরু থেকে মানুষকে মঙ্গলে ফাটানো সম্ভব না, কি কারনে সম্ভবনা সেটা আমাদের সবার জানা আছে।

মঙ্গল গ্রহে যাওয়ার যান

মঙ্গল গ্রহে যাওয়ার যান এখনো তৈরি হয়নি তবে এর কাজ চলছে । এর কাজ করছে দুটি সংস্থা একটি হচ্ছে নাসা আর অপরটি হচ্ছে  স্পেস এক্স। নাসা তার  নতুন বাজেটে দেখায় আগামী ২৪-২৫ বছরের মধ্যে ১০০ জন নবসারি নিয়ে মঙ্গল গ্রহের  উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করবে।

 স্পেসিক্স এর মালিক ইলন মাক্স বলেন তারা যেই স্পেসিক্স নিয়ে মঙ্গলের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করবে সেটির কাজ ২০২৫ -২০২৯ সালের মধ্যে শেষ হবে। আর এর কাজ শেষ হলে তার এক বছর পর মঙ্গলে নভোচারীদের পাঠাবে বলে জানিয়েছে মহাকাশ গবেষক।

পৃথিবী থেকে মঙ্গলের দূরত্ব

পৃথিবী থেকে মঙ্গলের দূরত্ব নির্দিষ্ট না। কারণ এদের দূরত্ব একেক সময় একেক রকম হয়ে থাকে তবে যখন পৃথিবী ও মঙ্গল সূর্যের একয় পাশে থাকে তখন এদের দূরত্ব ৫৬ মিলিয়ন কিলোমিটার। আর যখন পৃথিবী ও মঙ্গল সূর্যের উভয় পাশে থাকে তখন তাদের দূরত্ব প্রায় ৪০১ মিলিয়ন কিলোমিটার।

 অর্থাৎ ২০২০ সালে অক্টোবর মাসে মঙ্গল যখন পৃথিবীর কাছে চলে আসে তখন তার দূরত্ব ছিল ৩ কোটি ৮৬ লক্ষ মাইল দূরত্ব। আর তখন রাতের আকাশে গ্রহটি পৃথিবী থেকে খালি চোখে খুব উজ্জল ভাবে দেখা গিয়েছিল।

মঙ্গলকে লাল গহ বলার কারণ

রাতের আকাশে পৃথিবী থেকে মঙ্গলকে অনেকটা লাল দেখায় যার কারণে গ্রহটিকে লাল গ্রহ বলা হয়। আর মঙ্গল গ্রহ লাল দেখার প্রধান কারণ হচ্ছে মঙ্গল গ্রহে প্রচুর আয়রন অক্সাইড আছে । আর এই যৌগের জন্য রক্তে বনমরিচা লাল দেখায়। মঙ্গলের কেন্দ্র লোহা রয়েছে আরে লোহা গুলো পরিমাণে অঢেল হওয়ায় গ্রহটির পৃষ্ঠে অবরণ তৈরি হয়েছে যার কারণে গ্রহটি দেখতে লাল দেখায়।

সূর্য থেকে মঙ্গলের দূরত্ব

সূর্য থেকে পৃথিবী হতে তিন নাম্বার আর মঙ্গল হচ্ছে ৪ নাম্বার। আর সূর্য থেকে মঙ্গলের দূরত্ব হচ্ছে গড়ে ২২ কোটি ৮০ লাখ কিলোমিটার।

পৃথিবী থেকে মঙ্গলে যেতে যে সময় লাগবে

মঙ্গল গ্রহ নিয়ে বিজ্ঞানীদের আগ্রহ সবথেকে বেশি কারণ পৃথিবী পর যদি কোন গ্রহে মানুষ বসবাস করতে পারে সেটি হচ্ছে মঙ্গল। আর বর্তমানে পৃথিবী থেকে মঙ্গলের দূরত্ব কয়েক কোটি মাইল । আর যদি বর্তমানে মহাকাশযান পাঠাই  তা মঙ্গল গ্রহে পৌঁছাতে সময় লাগবে ৯ মাসের মত।

বিজ্ঞানীরা পরিকল্পনা করছে কিভাবে আলোর গতিতে যেতে পারবে যদি আলোর গতিতে যাওয়ার জন্য কোন যান তৈরি করতে পারে তাহলে পৃথিবী থেকে মঙ্গলে যেতে সময় লাগবে মাত্র ৩ দিন। আর এখন পর্যন্ত আলোর গতিতে যাওয়ার কোন যান বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করতে পারে নাই।

 

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url